বশির আল-মামুন, চট্টগ্রাম ব্যুরো : এবার চট্টগ্রামের একজন নারী উদ্যোক্তাকে বলির পাটা বানিয়ে ব্যাংক থেকে বিশাল অংকের ঋণ গ্রহনের অভিযোগ উঠেছে মাফিয়া এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে। এঘটনা জানাজানি হওয়ার পর এখন ওই নারী উদ্যোক্ত পড়ে যান বেকায়দায়। চট্টগ্রামের দাপুটে এই নারী উদ্যোক্তার নাম নাজমি নওরোজ। তিনি চট্টগ্রাম নগরের সাইফুদ্দীন খালেদ সড়কের লা এরিস্টোক্রেসি (বর্তমানে বন্ধ), ফিউশন ইটস নামের দুটি রেস্টুরেন্টের মালিক। সব মিলিয়ে তার দুই থেকে আড়াই কোটি টাকার ব্যবসা। এই ব্যবসা দেখিয়ে তিনি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন ১৫১ কোটি টাকা। বছরের পর বছর শোধ না করায় সুদে-আসলে এই ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৩৪ কোটি টাকা। তবে, নাজমি নওরোজ এই ঋণের পুরো দায়ভার চাপিয়েছেন এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ সাইফুল আলম মাসুদ ওপর। নাজমি দাবি করেছেন, এস আলমের কল্যাণেই তিনি এত টাকা ঋণ তুলতে পেরেছেন। ঋণ শোধও করবে এস আলম। এদিকে, ঋণ আদায়ে ব্যাংক ইতোমধ্যে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, নাজমি নওরোজের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের নাম নওরোজ এন্টারপ্রাইজ। আর এই নামের একজন উদ্যোক্তা হিসেবে নাজমি ২০১৫ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ৩টি শাখা ১৫১ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করেন।
ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, নাজমির লা এরিস্টোক্রেসি নামের একটি রেস্টুরেন্ট ছিল নগরীর সাইফুদ্দিন খালেদ সড়কে। যেটি ওখানকার আসকার দিঘীর পাড় এলাকায় (বর্তমানে বন্ধ)। প্রায় দুই কোটি টাকা বিনিয়োগের এই রেস্টুরেন্টটির বিপরীতে একই পরিমাণ ঋণ নেওয়ার সুযোগ থাকলেও, নাজমি নওরোজ স্থানীয় ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের শাখা থেকে ৭০ কোটি টাকা ঋণ নেন। ঋণ গ্রহণের পর কোনও টাকা পরিশোধ না করায় বর্তমানে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১৭ কোটি টাকা। এভাবে একই প্রতিষ্ঠানের নামে একই ব্যাংকের প্রবর্তক মোড় শাখা থেকে নাজমি ঋণ নেন ৫৪ কোটি টাকা, যা সুদে-আসলে বর্তমান পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯০ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। তিনি একই ব্যাংকের চকবাজার শাখা থেকেও ২৭ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করেন। মোট ১৫১ কোটি টাকা ঋণ নিলেও এর বিপরীতে জামানত দেখিয়েছেন ৪০ কোটি টাকার সম্পদ।
ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, নাজমি নওরোজের বর্তমান ঋণের পরিমাণ সুদে-আসলে প্রায় ২৩৪ কোটি টাকা। ২০২২ সাল পর্যন্ত তিনি ঋণ শোধ করেছেন মাত্র ১ কোটি ১০ লাখ টাকা। নাজমির মালিকানাধীন লা এরিস্টোক্রেসি রেস্টুরেন্টটি সাইফুদ্দিন খালেদ সড়ক থেকে আগ্রাবাদ এলাকায় স্থানান্তরের পর দীর্ঘদিন লোকসান দিয়ে সেটি বর্তমানে বন্ধ রয়েছে।
এ বিষয়ে নাজমি নাজমি নওরোজ ঋণ গ্রহণ ও পরিশোধ না করার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, আমি ৪০ কোটি টাকার সম্পদ জামানত দিয়ে শত কোটি টাকা ঋণ পাওয়ার কথা নয়। যা কিছু হয়েছে সবই এস আলম গ্রুপের মালিক মাসুদ সাহেবের ইচ্ছায়। আমি ঋণ উত্তোলনের পর সব টাকা এস আলমের মালিক মাসুদ সাহেবের ব্যক্তিগত সহকারী আকিজ উদ্দিনকে দিয়ে দিয়েছি। সেই প্রমাণ আমার কাছে আছে। তার নামের ব্যাংকের ঋণের সব টাকা এস আলমের মাসুদ শোধ করবেন বলেও জানান তিনি। এমনকি, ব্যাংক কর্তৃপক্ষের সাথেও বৈঠকে এই কথা জানানো হয়েছে বলে নাজমি দাবি করেন।
নাজমি নওরোজ ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের যেসব শাখা থেকে ঋণ নিয়েছেন, সেসব শাখায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে কেউ এ ব্যাপারে নিজ পরিচয় দিয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা জানান, নাজমি নওরোজ ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের আগের নিয়ন্ত্রক এস আলমের ঘনিষ্ঠ। এস আলমের মালিক সাইফুল আলম মাসুদ ও তার পিএস আকিজ উদ্দিনের নির্দেশনাতেই নাজমি নওরোজকে বিপুল অংকের ঋণ দেওয়া হয়। বছরের পর বছর শোধ না করলেও নাজমিকে ঋণ-খেলাপি দেখানো হয়নি এস আলমের নির্দেশেই। এদিকে, বর্তমানে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক এস আলমের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হওয়ার পর নাজমি নওরোজের কাছ থেকে ঋণের টাকা উদ্ধারের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।
ঘটনার সত্যতা জানতে এস আলমের গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ সাইফুলকে মুঠোফোনে কল করলেও নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। এ ছাড়াও, তার ব্যক্তিগত সহকারী আকিজ উদ্দিনের সঙ্গেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
এ বিষয়ে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চট্টগ্রাম উত্তর বিভাগের বিভাগীয় প্রধান মো. হাফিজুর রহমান বলেন, নাজমি নওরোজের কাছ থেকে ঋণের টাকা উদ্ধারের জন্য ব্যাংক নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। ইতোমধ্যে তাকে ডেকে এনে ঋণ পরিশোধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
Leave a Reply